শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
Led04ফতুল্লাবিশেষ প্রতিবেদন

আজ তল্লা ট্রাজেডির ৩ বছর

লাইভ নারায়ণগঞ্জ: আজ ৪ সেপ্টেম্বর, ৩ বছর আগে ঠিক এ দিন রাতে নারায়ণগঞ্জে ঘটেছিল ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মসজিদে নামাজ পড়তে এসে আগুনে ঝলসে গিয়েছিলেন অনেক মুসল্লি। নিজেকে বাঁচাতে অনেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নর্দমার পানিতে। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে শিশুসহ একে একে ৩৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। এখনো সেই ঘটনার কথা মনে হলে আঁতকে ওঠেন এলাকাবাসী।

প্রতিদিনের মতোই ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফতুল্লার তল্লায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়তে আসেন মুসুল্লিরা। ইমামের পেছনে ৪ রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করে কেউ কেউ বেরিয়ে যান। তবে বেশিরভাগ মুসুল্লিই ভেতরে সুন্নত নামাজ আদায় করছেন। এর মধ্যে তিতাসের জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের ভেতরে থাকা মানুষগুলোর শরীর ঝলসে যায়। কারও কারও শরীরে কোনো কাপড়ই ছিল না। এরপরেই এলাকাজুড়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে কয়েকজন সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারলেও ৩৪ জনের প্রদীপ নিভে যায়।

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও তার ছেলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন (১৬), মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান (৫০), ইমরান (৩০), আবুল বাশার (৫১), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), জেলা প্রশাসনের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শামীম হাসান (৪৫), স্থানীয় ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ নাদিম (৪৫), তল্লার বাসিন্দা নূর উদ্দিনের বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাব্বির (২১) ও মেজ ছেলে তোলারাম ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র জোবায়ের (১৮), জুলহাস উদ্দিন (৩০), মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাটবুকদিয়া গ্রামের কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পোশাক শ্রমিক জুলহাস ফরাজীর ছেলে জুবায়ের ফরাজী (৭), পটুয়াখালীর গলাচিপার আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. রাশেদ (৩০), পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৭২), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী গ্রামের জামাল আবেদিন (৪০), পোশাক শ্রমিক ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন (১২), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. জয়নাল (৩৮), লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুকপলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. নয়ন (২৭), ফতুল্লার ওয়ার্কশপের শ্রমিক কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), শ্রমিক মো. রাসেল (৩৪), বাহার উদ্দিন (৫৫), নিজাম ওরফে মিজান (৪০), আবদুস সাত্তার (৪০), শেখ ফরিদ (২১), নজরুল ইসলাম (৫০), ফতুল্লার নিউখানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে রিফাত (১৮)।

মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অভিযোগপত্রে মসজিদ পরিচালনায় কমিটির অবহেলা-অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎসংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও মুসল্লিদের জীবনের নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়া, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মিটার রিডার কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুসংযোগ দেওয়াসহ তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাসলাইন সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাসলাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন এবং স্থানান্তর না করার কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৩৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়।

এদিকে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও দায়ী করা হয় তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটিকে। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের হাতে ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। তদন্তে গ্যাস লাইনে লিকেজ, বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট, মসজিদ কমিটির অবহেলা ও রাজউকের অব্যবস্থাপনাকে বিস্ফোরণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

প্রতিবেদন দাখিলের পর তদন্ত কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা ববি জানিয়েছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ, বিদ্যুৎ বিভাগের ত্রুটি, মসজিদ কমিটির গাফিলতি, ভবন নির্মাণে রাজউকের অব্যবস্থাপনা এবং মসজিদের সামনের রাস্তা নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের অবহেলার বিষয়টি এসেছে। এছাড়া এসব অনিয়ম রোধে তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে ১৮টি সুপারিশ পেশ করেছে। এর মধ্যে মসজিদ নির্মাণের আগে আর্কিটেক্ট দিয়ে নকশা ডিজাইন করা, মসজিদ বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগের ব্যাপারে ম্যাপ আকারে বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে আশা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

RSS
Follow by Email