ত্বকীর জন্মদিন এবং অপরাজিত বাংলাদেশ
রফিউর রাব্বি: নীচু জাতের ছেলে নিতাই। বংশ পরম্পরায় ডাকাত। তাকেও ডাকাত হতে হবে। কিন্তু না নিতাই কবি হয়েছেন। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের নায়ক কবি নিতাই লিখেছেন, ‘হায়- জীবন এত ছোট কেনে? এ ভূবনে-।’ কথাটি আক্ষরিক অর্থে ত্বকীর ক্ষেত্রেই খাটে। দীর্ঘ এক যাত্রার প্রস্তুতিতেই তাকে থেমে যেতে হলো। না, থামিয়ে দেওয়া হলো। আজ ত্বকীর জন্মদিন। আটাশ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু কালের চক্রপ্রবাহে বয়স বেড়ে চললেও বয়স তার আটকে আছে সতেরো বছর পাঁচ মাসের বৃত্তে। পিটার প্যানের মতো ত্বকীর বয়স আর বাড়বে না কোনদিন। তবে পিটার প্যান চিরদিন কিশোর হয়ে থাকার জন্যে পণ করেছিল; কিন্তু ত্বকী তা করেনি। ত্বকী বড় হতে চেয়েছিল, অনেক বড়, সবকিছু ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকরা সে পথ রুদ্ধ করে ছুঁড়ে দিয়েছে এক রাশ অন্ধকার শুধু আমাদের দিকে নয়; গোটা সমাজের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে।
অ্যানা ফ্রাংকেরও মৃত্যু হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে। আঠারো পেরোবার আগে। আমস্ট্রাডামে বাবার অফিসে লুকিয়ে থেকেও বাঁচতে পারেননি। হিটলারের নাৎসী বাহীনি তাঁকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়েগিয়েছিল। সেখানেই টাইফাসে তাঁর মৃত্যু। অ্যানা ডায়েরিতে তাঁর শেষ সময়ের নির্মম যন্ত্রণার কথা লিখেছেন। কিন্তু ত্বকী তার শেষ সময়ের যন্ত্রণার কথা লিখে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। আমরা ঘাতকের জবানবন্দি থেকে তা জেনেছি। ত্বকীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টর্চার সেলে। এইটি কনেসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেরই এক ভিন্ন রূপান্তর। তাকে হাত-পা বেঁধে দলবদ্ধভাবে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে বুকের উপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছিল, উপরে ফেলা হয়েছিল তার চোখ, থেতলে দেয়া হয়েছিল শরীরের অঙ্গ। নিথর দেহটি বস্তাবন্দি করে ফেলে দিয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।
অ্যানা ফ্রাংকের স্থান ও কালটি ছিল ইয়োরোপ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। স্থান ও কালের ভিন্নতা হলেও হিংস্রতা, বর্বরতা ও মানবতার বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অর্ধ-শতাব্দীতেও তাতে কোন পার্থক্য গড়ে ওঠেনি। অ্যানার কোনও শত্রæ ছিলনা; কিন্তু রাষ্ট্র অ্যানার বিরুদ্ধে ছিল। ত্বকীরও কোনও শত্রæ ছিলনা; তবে রাষ্ট্র ত্বকীর ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছে। অ্যানার মৃত্যুর পর তার ডায়েরীর মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে সভ্যতার মোড়কে মোড়া এক বর্বরোচিত উপাখ্যান। ত্বকীর মৃত্যুর পর তার কয়েকটি খেঁড়ো খাতায় আমরা দেখতেপাই গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা গদ্য, কবিতা, গল্প ও বিভিন্ন কাব্যময় পংক্তির সমাহার। যা থেকে আমরা জানতে পারি সমাজের অন্তর্গত ভয়ঙ্কর সব ক্ষত সম্পর্কে তার ভাবনা, উদ্দীপনা, ক্ষোভ ও দুঃখবোধ।
‘আবুল হাসানের কবর থেকে ফিরে’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘কবরে কী করে পড়ো? মাটি কি কাগজ খাতা?/ তোমাকে মৃতের পাশে রেখে, ফিরে আসে তোমার কবর।/ আমাদের প্রত্যহের প্রবাহিত পাপে/ স্মৃতি তাপে জ্বলছিল প্রাণ/ এই চোখ মৃত্যু দেখে কোনো দিন কাঁদেনি/ শুধু প্রাণ কেঁদেছিল একবার…।’ চলে যাওয়ার পর ১১ টি জন্মদিন এসেছে ত্বকী ছাড়া ত্বকীর। ৫ অক্টোবরটি এখন শুধুই বেদনার। হৃদয় খুঁড়ে কেবলি বেদনা জাগিয়ে তোলা। ত্বকী সমাজের অনতিক্রান্তবৃত্তটি ভাংতে চেয়েছিল, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। স্যাঁতসেঁতে জমিনে দাঁড়িয়ে সে ডানা ছড়াতে চেয়েছিল আকাশে। একটা কবিতায় সে বলেছেন ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে/ হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’
তলস্তয় তাঁর ওয়্যার অ্যান্ড পিস গ্রন্থে বলেছেন, ‘সন্তানেরা যখন পিতাদের কবর দেয়, তখন দেশে শান্তি থাকে, পিতারা যখন সন্তানদের কবর দেয়, তখন দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে।’ দুর্ভাগা এ দেশে প্রায়ই কোনো না কোনো পিতার কাঁধে তুলে দেওয়া হচ্ছে সন্তানের লাশ। দেশে তা হলেকি যুদ্ধাবস্থা চলছে! প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আর এসব নতুন নামের ভিড়ে ধুলো আচ্ছাদিত হচ্ছে পুরোনো সব নাম। এসব হত্যার কারণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও এসবের বিচার না হওয়াটাই রাজনীতির নিয়ম। আর দু-একটির যা-ও হয়, তা-ও রাজনীতির প্রয়োজনে।
নিহত হওয়ার কয়েক দিন আগে ত্বকী তার খেরো খাতার এক জায়গায় লিখেছে, ‘কোকিলের পাশাপাশি উড়ে চলে/ শোকের কালো পতাকা।’ কালো রং ত্বকীর প্রিয় ছিল। বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে লাশকাটা ঘরে যাওয়ার শেষ সময়টি পর্যন্ত ওর গায়ে ছিল সেই কালো-জামা। এ জামাটিই শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে কাদাবালিতে মেখে থাকা ত্বকীকে সনাক্ত করতে সহায়তা করেছে।
তদন্তকারী সংস্থা র্যাব ১০ বছর আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, ত্বকীকে টর্চার সেলে নিয়ে ১১ জন মিলে হত্যা করেছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হলেও সে অভিযোগপত্র আজো আদালতে জমা পড়েনি। বিচার শুরু হয়নি। ঘাতকের শক্তি-মত্তা, শৌর্য-বীর্যের পাথুরে দেয়ালে কেবলই মাথা ঠুকছে আমাদের বিচারের কাঠের হাতুড়ি। কিন্তু বিচার হয় না। দেশে দেশের বাইরে কতশতজন বিচার চেয়ে চলেছেন এখনো। কতজন মৃত্যু বরণ করেছেন বিচার চাইতে চাইতে। কবি রফিক আজাদ ‘জবাব দাও বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তাদের সুতীক্ষ্ণ রক্তচোখের ভেল্কিবাজিতে আমি চন্দ্রাহত হই!/ আহত হয় আমার স্বাধীনতা/ পতাকা ম্লান করে শোকাকুল মায়ের ব্যাকুলতা/ পিতার আহাজারি আর বোনের আর্তচিৎকার।/ ত্বকীর মতো কিশোরের রক্তে শীতলক্ষ্যার পানি আজ একাকার!/ দানবতুল্য এই হায়েনাদের জন্য কি মুক্তিযুদ্ধ করেছি একাত্তরে?/ জবাব দাও বাংলাদেশ, নইলে/ আমাকেই করো তিরস্কার।’ কিন্তু কে জবাব দেবে? রাষ্ট্র না সরকার? রাজা যায় রাজা আসে রাষ্ট্রেরতো বদল হয় না। সরকার বদলের সাথে সাথে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দিতে চায়। জনগণের রাষ্ট্রকে সরকার নিজেদের রাষ্ট্র বানিয়ে নেয়। রাষ্ট্রের মালিকানা দখল করে নেয়। কিন্তু একাত্তরের বাংলাদেশ যে দানবের, হায়েনার, ঘাতকের অভয়ারণ্য হতে পারে না। বাংলাদেশ পরাজিত হতে পারে না, হবে না।
রফিউর রাব্বি : তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।