শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
রাজনীতি

না.গঞ্জে ৩রা নভেম্বর, শ্রমিক অভ্যুত্থান বিপ্লবী সংগ্রামের এক ইতিহাস

এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল: নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিল শ্রমিক আন্দোলনের দূর্গ। শুধু শ্রমিক আন্দোলন নয়, দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, এমনকি ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পল্টন ময়দানের লাখো জনতার সমাবেশ ভরে তুলতো এই নারায়ণগঞ্জে পাটকল-বস্ত্রকলের শ্রমিকরা। শীতলক্ষ্যা নদীর ২ পাড়ে পাট ও বস্ত্র শ্রমিকরা ছিল এক সময়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রান শক্তি। ১৯৮০ পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জে পর্যায়ক্রমে পাট শিল্পের স্থান দখল করে নেয় গার্মেন্টস কারখানা।

এক পর্যায়ে পাট শিল্পের পরবর্তী স্থান দখল করে নেয় গার্মেন্টস শিল্প কারখানা। এই গার্মেন্টস শিল্প অতিদ্রুত বিকাশ গঠতে থাকলেও শ্রম আইন উপেক্ষিত হয় মালিকদের দ্বারা। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে, বঞ্চিত শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মনোযোগ দেয়া বা কিছু করার মত আর কেহ থাকে না। কথায় কথায় শ্রমিক ছাটাই, সাপ্তাহিক ছুটি না দেয়া, একদিন এবসেন্ট করলে ৩ দিনের হাজিরা কেটে দেয়া, কর্মদিবস ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা, সময় মতো বেতন না দিয়ে ঘুরানো। এক কথায় দীর্ঘদিন যাবৎ গার্মেন্টস মালিকদের অমানবিক শোষণের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ঘূণিভূত হয়ে তখন চরম আকার ধারণ করেছিল। এছাড়াও ঐ সময়ে ফতুল্লার পলমল গার্মেন্টস, বিসিকের ফকির এ্যাপারেলস, সামস রেডিওয়্যার, তামান্না গার্মেন্টস, জি,আর, ফ্যাশনসহ বহু কারখানায় শ্রমিকেরা নিজেদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে আসছিল।

প্যানটেক্স গার্মেন্টেসে ২০০৩ সালে ৩রা নভেম্বর রাতে কি ঘটেছিলঃ

৮ ঘন্টা কর্ম দিবস, ওভার টাইমের মজুরি সহ ১৮ দফা দাবিতে ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীর প্যানটেক্স ড্রেসি লি: গার্মেন্টস এর গেটের সামনে একটানা ৩ দিন যাবৎ শ্রমিকেরা অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিল। ২রা নভেম্বর ২০০৩ এর রাতে প্রশাসন বিসিকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে; হঠাৎ সেখানে ৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে মালিকের শিপমেন্ট খালাস করার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠে। এজন্য তারা আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে বৈঠকের নামে নানা প্রকার মিথ্যা আশ্বাস দিতে থাকে।অতীতে মালিকদের আশ্বাসের নামে ধোঁকাবাজির অভিজ্ঞতা এবং মালিকদের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমার উপস্থিতি ছাড়া মালিক প্রশাসনের সাথে কোন বৈঠক করতে রাজি না হওয়াতে, রাত সাড়ে ১১ টার দিকে মোবাইল ফোনে ওসি ফতুল্লা আমাকে বলেন-আন্দোলনরত শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করার জন্য তারা আমাকে সহ বসতে চায়। আমি তখন তাদের জানাই, আগের দিন বিকাল ৫টায় ঐ কারখানার ভিতরে মালিক শ্রমিক দ্বি-পাক্ষিক ৫ ঘন্টার বৈঠকে শ্রমিকদের পক্ষে আমি ছিলাম। মালিক শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিটি মেনে না নেওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হয় নাই। তখন ঐ পুলিশ অফিসার অধিক আগ্রহে আমাকে বলেন, আপনি যদি এখন আসেন, তবে পুনরায় আলোচনা করে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস সহ ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়া হবে। তার সামনে বসা তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট তাদের নাম পরিচয় দিয়ে, একের পর এক আমার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তারা মালিকের সাথে কথা ফাইনাল করার জন্য আধা ঘন্টা সময় নিয়ে পুনরায় আমাকে কনফার্ম করলেন, মালিক ৮ ঘন্টা কর্মদবিসের দাবি এখন মেনে নিয়েছে। আমি বললাম, তবে শ্রমিকদের একথা আপনারা জানিয়ে দিন। তারা জানালেন, আমি সেখানে না গেলে শ্রমিকেরা তাদের কথা বিশ্বাস করবে না। তখন তারা আর দেরি না করে আমাকে বিসিকে আসার জন্য খুবই অনুরোধ করেন।

এমনিতেই ছিল শীতের রাতের কুয়াশা, আবার রমজান মাসের কারণে বিসিকের অধিকাংশ কারখানার বাতি নেভানো থাকায় চারদিক ছিল থমথমে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্যানটেক্স গার্মেন্টস এর গেটে গিয়ে দেখি আমাদের সংগ্রামী শ্রমিক ভাই বোনেরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে, আমাকে দেখতে পেয়ে তারা উৎসাহিতও শ্লোগান মুখর হয়ে উঠে। উল্লেখ্য থাকে যে, নারায়ণগঞ্জ হল ঐতিহ্যগত ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে কেন্দ্রস্থল । প্রত্যক্ষ ভাবে আমার এবং আমাদের সংগঠনের পরিচালনায় বহু কারখানায় দাবি-দাওয়া আদায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন সহ ন্যায় সংঘত দাবি আদায় হয়েছিল। এ ধরনের একটি আন্দোলনের অভিজ্ঞতার পটভূমি পূর্ব থেকেই গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
এদিকে বিসিকের চারদিকে আন্দোলনের উত্তাপ তখন ক্রমশ: বেড়েই চলছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনমুখী এই টগ্বগে অবস্থা প্যানটেক্স গার্মেন্টস মালিক পক্ষ কখনোই গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। উপরন্তু নিজেকে স্বরাষ্ট্র সচিবের আত্মীয় বলে মিথ্যা পরিচয় জাহির করে সরকারি দল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে, টাকার দাপটে উক্ত মালিক বেপরোয়া মারমুখী হয়ে উঠে। তারা শ্রমিকদের উপরে দমন পীড়ন খুবই বাড়িয়ে দেয়, এমনকি রমজান মাসে শ্রমিকদের নামাজের সময় অজুর কল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। এতে শ্রমিকেরা আরও উত্তোজিত হয় উঠে। এমতাবস্থায় ২রা নভেম্বর, ২০০৩ইং তারিখে মালিক দাবি না মেনে তালবাহানা করার কারণে শ্রমিকেরা শিপমেন্ট আটকে দিয়ে কারখানা ঘেরাও করে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এটাই ছিল তখন তাদের একমাত্র পন্থা, যাতে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের ক্ষমতা ও উৎপাদনে শ্রমিকদের অবদানকে স্বীকার করতে পারে। শ্রমিকরা রাতের ঘুম হারাম করে ৩ দিন / ৩ রাত একটানা কারখানা ঘেরাও করে গেটের সামনে মাটিতে বসে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। আমি সেখানে গিয়ে আমার সাথে কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনে ম্যাজিস্ট্রেট ও ওসি ফতুল্লার সঙ্গে যে কথা হয়েছে, তা সর্বপ্রথম কারখানার গেটের সামনে আন্দোলনত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সবকিছু তাদের অবহিত করি।

অতঃপর নেতা পর্যায়ের কয়েকজন গার্মেন্টস শ্রমিককে সংগে নিয়ে বৈঠকের স্থান পার্শ্ববর্তী ভবনের ৮ম তলায় যাই এবং চুক্তিনামার কথা জিজ্ঞাস করি। তখন চুক্তির বিষয় নিয়ে তারা গড়িমসি করতে থাকে। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট, মালিক ও তাদের কয়েকজন মাস্তান সবাই আমার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে উগ্র ভাষায় কথাবর্তা বলতে থাকে, পিস্তল শো করে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এনডিসি সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে মালিক ও পুলিশের কর্তারা শ্রমিকদের অবস্থান ধর্মঘটের স্থানে যেয়ে, শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলে। শ্রমিকরা বলে, যে মালিক এখন এক কথা বলে ২ ঘন্টার মধ্যে সে কথা পাল্টিয়ে ফেলে, তাকে বিশ্বাস করা যায় না। শ্রমিকেরা তাদের দাবির ব্যাপারে আরও অনড় হয়ে উঠে। এবার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কর্তারা সরাসারি মালিকের পক্ষ নিয়ে শিপমেন্ট এর মাল খালাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ম্যাজিস্ট্রেট বেলাল হোসেন চোখ লাল করে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলে, আন্দোলন বাদ না দিলে শ্রমিকদের লাশের ওপর দিয়ে তারা শিপমেন্ট করাবে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আরও কয়েক ট্রাক পুলিশ বিসিক এলকায় প্রবেশ করে প্যানটেক্স গার্মেন্টস এর সামনে অবস্থান নেয় এবং কারখানা এলাকার চারপাশে পুলিশ ঘেরাও করে রাখে।

ভোর সোয়া ৫টার দিকে আমাকে গ্রেফতার করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়। সকাল পৌনে ৬টায় বন্দি অবস্থায় থানার ওয়্যারলেস সেটেবিসিকে রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পাই। পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র আন্দোলনরত অসহায় শ্রমিকদের ওপর। রমজান মাসের পরিবর্তিত ডিউটির সময়সূচির কারণে সকাল ৭টার দিকে কারখানামুখী ৫০/৬০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর হাজার-হাজার রাউন্ড গুলির শব্দে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠে। শ্রমিকের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, শ্রমিক হত্যা এবং বিনা কারণে আমাকে থানায় আটক করার সংবাদ বিসিকসহ পার্শ্ববর্তী সকল গার্মেন্টস কারখানায় দাবানলের আগুনে মতো ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশি অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিক বসতির আশে পাশের বাসাবাড়ী, বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী হঠাৎ বাঁধ ভাঙা প্লাবনের মতো রাস্তায় ব্যাপক প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলে। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন আগ্নেয়গিরির মতো তীব্র গতিতে পুরো শহরে শ্রমিক বিস্ফোরণ ঘটে। শহরের চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অনবরত মিছিলের পর মিছিল চলতেই থাকে। প্রতিরোধের মিছিল যেন শেষ হতে চায় না, একটানা চলতেই থাকে। একটানা ১০/১৫ দিন নারায়নগঞ্জ প্রশাসনের অত্যাচারের খড়গ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে পড়ে যায়। রাজপথ দখল করে নেয় বিপ্লবী শ্রমিকেরা। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক জনতা পঞ্চবটি, শাসনগাঁও, কাশিপুর, জামতলা, ফতুল্লা, বিসিকের ৫০/৬০ হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক সকল পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে বীরদর্পে থানা থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য ফতুল্লা থানা ঘেরাও করে ফেলে। এ সংবাদ জানতে পেরে পাগলা, শ্যামপুর, কাঠেরপুল, পোস্ট অফিস এলাকা সহ পাশ্ববর্তী সকল কল-কারখানার শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো শুধু ফতুল্লা থানার দিকে ছুটে আসতে থাকে।মিনিটে মিনিটে থানার চারদিকে শ্রমিকদের চাপ ক্রমশ:ভয়াবহ আকারে শুধু বেড়েই চলছে। যে কোন সময় বিরাট রক্তারক্তি হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে থানা থেকে সকল পুলিশ যে-যেভাবে পারে দ্রুত পালিয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ সেন্ট্রি ছাড়া থানা তখন পুলিশ শূন্য। থানার চতুর্দিকে শ্রমিকদের শ্লোগানের গর্জন প্রকট আকার ধারন করছে, থানা কেঁপে উঠছে। এমনিতর মুহূর্তে আহত বাঘের গর্জনের মতো হাজার-হাজার শ্রমিক থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। আমার মনে হয় আমাকে মুক্ত করতে ঐ মুহূর্তে হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। এমতাবস্থায় থানার গারদ ভেঙে শ্রমিকেরা আমাকে যখন বাইরে মেইন রোডে মুক্ত করে নিয়ে আসে তখন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা পুলিশ বেপরোয়াভাবে শর্টগানের গুলি চালাতে শুরু করে। এবং ৭০/৮০ জন শ্রমিক আমার সামনে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবীগণ জানালো আমাকে আটকের প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেছে। ঐদিন সকাল ১১ টায় ঘটনা জানতে পেরে স্থানীয় বামপন্থী নেতা এড.মন্টু ঘোষ, সফিউদ্দিন আহম্মেদ, বিমল দাস প্রমূখ নেতৃবৃন্দ সহ হাজার হাজার শ্রমিক এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ডিসি অফিসের সামনে শ্রমিক সমাবেশে যোগ দেয় এবং সাথে সাথে আমিও কয়েক হাজার শ্রমিকের একটি মিছিল নিয়ে ডিসি অফিস সমাবেশে পৌঁছাই। এদিকে শহর এবং পার্শ্ববর্তী রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বিক্ষোভ মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। মিছিল প্রতিরোধের ঢেউ ঝড়ের বেগে বেড়েই চলছে, আশে-পাশের এলাকার অন্যান্য পেশায় শ্রমিক ও মেহনতি মানুষেরাও ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে এগিয়ে আসতে থাকে। শহরে চলতে থাকে অঘোষিত হরতাল, বিকাল ৫ টায় কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতা কমরেড আবদুল্লাহ সরকারের সাথে স্থানীয় ১১ দলের নেতাদের বৈঠকে ৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে সর্বাত্মকভাবে হরতাল ঘোষণা করা হয়। রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং পরেরদিন সংবাদপত্রে এ খবর জানতে পেরে সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ধিক্কার ও নিন্দা জানানো হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। অবশেষে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সরকার প্রশাসন তাদের অ্যাকশন থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। মালিক প্রশাসন শহীদ আমজাদ হোসেন কামালের লাশকে ভয় পেয়ে, প্রশাসন ও গিয়াসউদ্দিন এম.পি বিডিআরের পাহাড়ায় রাতের অন্ধকারে কাশিপুরে তাকে দাফন করে দেয়। ৫ নভেম্বর হরতাল চলাকালিন প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং বাসদ আহ্বায়ক জননেতা কমরেড খালেকুজ্জামান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আবদুস ছালাম ছুটে আসেন ২নং রেল গেইট-এর বিশাল শ্রমিক সমাবেশে। সমাবেশে এক দাবি, শ্রমিক হত্যার বিচার চাই, করতে হবে। এ সময়ে ড. কামাল হোসেন ৭ দিনের মধ্যে বিসিকে শহীদ কামাল হত্যার বিচার ও ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। অন্যথায় বিচার বিভাগীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করে প্যানটেক্স গার্মেন্টসে গুলি, শ্রমিক হত্যার কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন। অবশেষে বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানকে প্রধান করে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছিল।

অতঃপর ৬ ডিসেম্বর ২০০৩ইং তারিখে বিকেএমইএ কার্যালয়ে সরকার, উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিসহ শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই ঘটনাই প্রমাণ করে গার্মেন্টস মালিকেরা কিভাবে শ্রম আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। গার্মেন্টস সেক্টরে মালিকেরা যে নব্যদাস ব্যবস্থা কায়েম করেছে-৩রা নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শ্রমিক অভ্যুত্থান হলো তার একটি আনুষ্ঠানিক জবাব মাত্র। গার্মেন্টস মালিকেরা রাতা-রাতি পাজেরো গাড়ি আর কোটি টাকার বাড়ী তৈরি করেন এবং বিদেশে টাকা প্রচার করেন অথচ যে শ্রমিকদের হাড়ভাঙা মেহনতে দেশের ৭৬% ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়, সে শ্রমিক থাকে সবচেয়ে অবহেলিত, অধিকারবিহীন।

নারায়ণগঞ্জে ৩রা নভেম্বর শ্রমিক অভ্যুত্থান বিপ্লবী সংগ্রামের এক খন্ড ইতিহাস। গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপরে জুলুম-নির্যাতনে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভ-৩রা নভেম্বর একটি বিস্ফোরণ মাত্র। এ অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিন মার খাওয়া শ্রমিকেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। রাজপথে শ্লোগানের ধ্বনিতে প্রতিবাদের ভাষা নিজেদের অস্তিত্বের শক্তিকে অনুভব করতে শিখেছে। একবার মা ডাক শিখে যে শিশু, সে ডাক আর ভুলে না, তেমনি “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগান একবার যে শ্রমিক শিখেছে সে কখনো আর ভুলবে না।

দুনিয়ার মজদুর এক হও।

লেখক: এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল
সভাপতি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

RSS
Follow by Email