শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
Led04জেলাজুড়েবিশেষ প্রতিবেদনসোনারগাঁ

সোনারগাঁয় দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষন বায়োস্কোপ

লাইভ নারায়ণগঞ্জ: সোনারগায়েঁ কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণের বস্তু হলো ঐতিহ্যবাহি বায়োস্কোপ। ‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল’ এই সুরে সুরে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছেন বায়োস্কোপওয়ালা আবদুল জলিল মন্ডল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ায় বায়োস্কোপকে ঘিড়ে উপচে পড়া ভির দর্শনার্থীদের। টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেল আসার পর বায়োস্কোপ যখন বিলুপ্তপ্রায়, তখনো বায়োস্কোপ দেখিয়েই সংসার চালান আবদুল জলিল মন্ডল।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত মেলায় প্রতিবছরের মত এবারও তিনি সদূর রাজশাহী থেকে হাজির হয়েছেন দর্শনার্থীদের বাইস্কোপ দেখাতে। প্রায় ৪০ বছর যাবত বায়োস্কোপ দেখান তিনি। এটিই তার মূল পেশা। বর্তমানে গ্রামবাংলায় বায়োস্কোপ এমনই বিরল যে, জাদুঘরে রেখে দেওয়ার জন্য অন্তত একটি বাইস্কোপ পাওয়া যাবে না।

শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা গেছে সোনারগাঁয়ে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের গানের সাথে সুর মিলিয়ে বায়োস্কোপ দেখিয়ে মুখরিত করছেন বাইস্কোপওয়ালা আব্দুল জলিল মন্ডল।

বায়োস্কোপের ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালি কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। তবে, যারা শহরে বড় হয়েছেন তাদের কাছে মনে হতে পারে বায়োস্কোপ কোন হাস্যকর এক বোকা বাক্স মনে হতে পারে।

বায়োস্কোপ এমন একটি বাক্স, যার ভেতর চোখ রাখতেই দেখা যায় নানা রকমের দৃশ্য। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ফলক, জমিদারবাড়ি, মজার ঘটনাসহ একের পর এক ছবি আসতে থাকে এবং গানের তালে তালে দৃশ্যগুলো ব্যাখ্যা করা হয়।

ইতিহাসমতে, স্টিফেন্স নামের এক বিদেশি বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখান। ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে স্টিফেন্স কলকাতায় এসেছিলেন। আর তখনই তিনি বিদেশি কিছু চিত্রের মাধ্যমে কলকাতায় প্রথম দেখিয়ে যান বায়োস্কোপ। তাঁর অনুপ্রেরণায় ১৮৯৮ সালে মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন দুই বছর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।

কালের বিবর্তনের কারণে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার বিনোদনের এ মাধ্যমটি। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মুঠোফোনের সহজলভ্যতার কারণে আপনা-আপনিই
উঠে গেছে এ বায়োস্কোপ। তবুও কোথাও না কোথাও একজন থাকে, তাদের মধ্যেই একজন বায়োস্কোপওয়ালা আব্দুল কাদের মন্ডল।

রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানার চায়ের শারাহ গ্রামের মৃত বকশি মণ্ডলের ছেলে জলিল মণ্ডল। তার বাবা বকশি মণ্ডল দীর্ঘ ৪৪ বছর এ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। তারই উত্তরসূরি হিসেবে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনিও এ পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

বায়োস্কোপ পেশার সঙ্গে আব্দুল জলিল মন্ডল দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, পূর্বে আমার বাবা বায়োস্কোপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারই হাত ধরে ১২ বছর বয়সে এ পেশায় নামি এবং ৪০ বছর যাবত বায়োস্কোপের সাথে জড়িত রয়েছি। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম-গঞ্জের পথে-ঘাটে হাটবাজারে আমি ও বাবা বায়োস্কোপ দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছি। তখন ধান, চাল ও অর্থের বিনিময়ে বায়োস্কোপ দেখানো হত। আগে বিভিন্ন প্রেম কাহিনী, তারপর যুদ্ধ, বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় বিষয় ও রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করা হতো।

তার এ বায়োস্কোপে এক সঙ্গে ৬ জন প্রদর্শনী দেখতে পারবেন। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ঘরে ঘরে টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোন চলে আসায়, বায়োস্কোপের জৌলুস কমে গেছে। বর্তমানে আমি বিভিন্ন মেলায় বায়োস্কোপ দেখাই। আর প্রতিবছরের মতো এবারো জাদুঘরের মেলায় এসেছি। এখন বায়োস্কোপের চাহিদা নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে বায়োস্কোপের ঐতিহ্যবিলীন হয়ে গেছে।

আব্দুল জলিল মণ্ডল আরও জানান, তিন পুরুষ ধরে বায়োস্কোপের পেশা। অবশ্য বাবা ও দাদা যে বাক্সে বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন সেটি নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। তারপর নতুন করে বানিয়ে নেয়া এ বাক্সটি নিয়েই চলছে জীবন ও জীবিকা।

সোনারগাঁওসহ বাংলা একাডেমিতেও তিনি বায়োস্কোপ দেখান। বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলায় তিনি বাইস্কোপ দেখিয়েছেন। আব্দুল জলিল মন্ডল ব্যক্ত করেন তার মতো কেউ বায়োস্কোপ দেখাবেন না। সোনারগাঁয়ে বায়োস্কোপে জনপ্রতি রাখা হয় ২০ টাকা করে। বর্তমানে তার আয় খুবই নিম্ন। বায়োস্কোপ দেখিয়ে তিনি দীর্ঘসময় উপার্জন করেছেন কিন্তু বর্তমানে স্বল্প পরিমাণ আয়ে সংসার চালাতে তিনি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে স্বপরিবারে বেড়াতে এসেছেন মো. সোলাইমান মিয়া। তিনি বলেন, আমি গ্রামে বড় হয়েছি। চাকুরীর সুবাদে দীর্ঘ ২৫ বছর ঢাকা আছি। স্কুলে পড়া কালীন সময়ে কতো বায়োস্কোপ দেখেছি। কিন্তু ঢাকায় আসার পর একদিনের জন্যেও এই জাদুর বাক্সটির কোথাও দেখিনি। আজ সোনারগাঁয়ে এসে বায়োস্কোপ দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছে। ছেলেবেলার সেই-ই স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন এই বায়োস্কোপওয়ালা।

বি এ এফ শাহিন কলেজের বাৎসরিক বনভোজনে এসেছেন শিক্ষার্থী মো. সাইদুল ইসলাম পিয়াস ও তার বন্ধুরা। পিয়াস বলেন, বইয়ে এবং টেলিভিশনে বায়োস্কোপের নাম অনেক শুনেছি। আমার দাদীর কাছে বায়োস্কোপের অনেক গল্প শুনেছি। আমি এটি দেখার জন্যে বেশ আগ্রহী ছিলাম। বায়োস্কোপ যে দেখতে পাবো কখনো ভাবিনি। সোনারগাঁয়ে এসে আজ আমার মনের বাসনা পূর্ণ হয়েছে।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার বলেন, বায়োস্কোপ আমাদের লোকজ ঐতিহ্য। লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য বায়োস্কোপ টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

RSS
Follow by Email