সোমবার, অক্টোবর ১৪, ২০২৪
Led01নারী ও শিশুসিদ্ধিরগঞ্জ

জীবন সংগ্রা‌মের বড় ‘যোদ্ধা মা’ সিদ্ধিরগঞ্জের নাসিমা

লাইভ নারায়ণগঞ্জ: দুমুঠো ভাতের আশায় ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে চায়ের দোকানের পাশাপাশি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন নাসিমা আক্তার (৪৫) নামের এক নারী। স্বামী থেকে শুরু করে কোনো আপনজন না থাকায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে দীর্ঘদিন ধরেই এই কষ্টসাধ্য কাজ করে আসছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়। তখন তার দুই মেয়ে এবং পেটে এক সন্তান ছিল। এরপর জীবন চালিয়ে নিতে বেছে নেন চায়ের দোকান। কিন্তু ছোট্ট এই দোকান চালিয়েও সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হওয়ায় বর্তমানে এর পাশাপাশি বেছে নিয়েছেন অটোরিকশা চালানোর মতো দু:সাধ্য কাজ। একজন নারীকে অটোচালক হিসেবে দেখে প্রতিনিয়ত অবাক হোন যাত্রীরা। অনেকেই এ নারীকে কাজ করার সাহস যোগাচ্ছেন। অনেকেই আবার নানা কটু কথা শোনান তাকে। তবে এগুলোকে তোয়াক্কা করেন না নাসিমা আক্তার।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যস্ততম পয়েন্ট শিমরাইল মোড় এলাকায় ডেমরা সড়কে অটোরিকশা চাালিয়ে এবং রাতে দোকানে চা বিক্রি করেন ওই নারী। বসবাস করেন ডেমরার শুকুরসী এলাকায়। বিধবা নাছিমার সংসারে তিন মেয়ে। এভাবে কাজ করেই বড় মেয়ে জোসনার (২০) বিয়ে দিয়েছেন। মেঝ মেয়ে ফারজানা (১৫) ও ছোট মেয়ে ফারিয়াকে (১০) একটি মাদরাসায় রেখে পড়াচ্ছেন। নাসিমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের কামারপাড়ায় তার জন্ম। সেখান থেকে বাবা মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। এক সময় আব্দুর বারেকের সাথে আমার বিবাহ হয়। তিনি ট্রাক ড্রাইভার ছিল। সুখের সংসারই ছিল তার। হঠাৎ একদিন তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বর্তমানে তার পিতা-মাতাও বেঁচে নেই। তিন মেয়েকে নিয়ে বাঁচার তাগিদে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ডেমরা সড়কের গলাকাটা পুলের পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন তিনি।

কান্নাজড়িত কন্ঠে নাসিমা আক্তার বলেন, আমি গরীব মানুষ। এখনো আমার দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটাতে হয়। তাদের পেছনে মাসে অনেক টাকা খরচ হয়। আগে ঘরভাড়া দিয়ে থাকতাম। কিন্তু পড়াশোনার খরচ দিতে গিয়ে এখন ঘরভাড়া দিতে পারি না। তাই রাস্তার পাশে কোনোরকম এক বাসা তৈরি করে বসবাস করি। বর্তমানে সন্ধ্যায় ৭ টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি। পরে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল পর্যন্ত অটোরিকশা চালাই। এভাবেই কোনোরকমভাবে বেঁচে আসছি। অনেকেই আমাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে। কে বললো তা তো শুনে আমার লাভ নেই। আমি আমার মতো চলি। মানুষ মনে করে আমাকে খারাপ। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করি।

অনেক জায়গায় চাকুরী চেয়েও ব্যর্থ হয়ে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় আমি চাকুরী করতে গিয়েছিলাম। আমি মোটা বলে আমাকে চাকুরীতে নেয় না। এরপর আমি অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটি চায়ের দোকান দেই। কিন্তু ওই দোকান দিয়ে যে ইনকাম হয় তা দিয়ে আমার সংসার চলে না। তাই পরবর্তীতে একটি অটোরিকশা কিনতে বাধ্য হই। এই দুইটা দিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমি নারী বলে অনেকেই আমার অটোরিকশা উঠতে চায় না। আমি অটোরিকশা চালাই অনেকেই বিষয়টা ভালোভাবে নেয় না।

বুকভরা আশা নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে নাসিমা আক্তার বলেন, আমাকে যদি সরকার সহযোগিতা করতো কিংবা আমাকে যদি অন্তত একটা থাকার ঘর তৈরি করে দিতো তাহলে আমি একটু ভালো করে চলতে পারতাম। তাহলেই আমি খুশি থাকবো। অনেক কষ্টের মধ্যেও আমি আজ পর্যন্ত কারো কাছে কখনো হাত পাতি নাই। বয়স হয়ে যাওয়ায় অটোরিকশা চালাতে গিয়ে আমার শরীর অনেক ব্যাথা করে। তারপরও কষ্ট করে গাড়ি চালাতে বাধ্য হই। আবার টানা দোকানদারিও করতে পারি না। পা ফুলে যায়। আমার পাশে তো কেউ দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই নেই। আমি অনেক কষ্টে আছি। এভাবে আর কতদিন কষ্ট করে যাবো তা আল্লাহই ভালো জানেন। বড় মেয়ের মতো আমার বাকি দুই মেয়েকেও মানুষের মতো মানুষ বানিয়ে বিয়ে দিতে পারলেই আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়ার কিছু থাকবে না।

তার দোকানে চা খেতে আসা এক ক্রেতা জানান, আমার নিয়মিত তার দোকানে চা খেতে আসা হয়। তিনি তার দুই মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। মাঝেমধ্যে তাকে দোকান চালানোর পাশাপাশি অটোরিকশা চালাতে দেখি। তিনি নারী হয়েও যেভাবে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন তা দেখে নিজেদের কাছেও খুব খারাপ লাগে।

আবুল কালাম নামের ওই এলাকার এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তাকে ডেমরা-শিমরাইল সড়কের অটোরিকশা চালাতে দেখি। বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে অটোরিকশা চালানোটা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। তার পাশে যদি সরকার দাঁড়াতো তাহলে তার এই কষ্ট লাঘব হতো বলে আমি মনে করি।

নারায়ণগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান সরদার জানান, আমরা এই ধরণের নারীকে সাধুবাদ জানাই। উনি প্রতিকূলতা জয় করে কারো কাছে হাত না পেতে যেভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন পাশাপাশি দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন তাতে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া কোনো কাজেই নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই তা তিনি প্রমাণ করলেন। আশা করছি, তাকে দেখে অনেক নারী এভাবে প্রতিকূলতা জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

RSS
Follow by Email